ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩: আশার আলো নাকি শুধুই নিরাশা?
লেখক: ইসরাঈল খান তারিখ: ৭ অক্টোবর, ২০২৫
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ পাস হওয়ার পর থেকে দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। "দলিল যার, জমি তার"—এই স্লোগানটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তবে আইনটির বাস্তব প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ নিয়ে ততটা নিবিড় বিশ্লেষণ এখনও চোখে পড়ে না। বাস্তবতা হলো: আইনের মধ্যে আশার দিক যেমন আছে, তেমনি আছে নিরাশার দিক।
বাংলাদেশে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ, জালিয়াতি ও অবৈধ দখল বহুদিনের সমস্যা। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো সেইসব অনীয়ম, প্রতারণা ও অবৈধ দখল রোধ করে দ্রুত প্রতিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু আইনটি কতটা কার্যকর ও ন্যুনতম ক্ষতির সঙ্গে প্রয়োগযোগ্য—এটি স্বাধীনভাবে যাচাই করার দাবি রাখে।
“দলিল যার, জমি তার” — কি সত্যিই এত সহজ?
আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী "দলিল" শব্দটি বিস্তৃতভাবে ধরা হয়েছে। এতে কেবল হস্তান্তরপত্রই নয়, খতিয়ান, নকশা, স্কেচ ম্যাপ, রসিদ, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের দাখিলা, বরাদ্দপত্র, ছাড়পত্র, অনাপত্তিপত্র—এসবকেই দলিল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফলে খতিয়ানও মালিকানার অন্যতম প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এতবড় সংজ্ঞা বাস্তবে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে—বিশেষত যখন খতিয়ানে ভুল থাকে বা সংশোধনের মামলা চলছে। খতিয়ান সংশোধনের মামলা অনেক সময় দীর্ঘসূত্রী হয়, ফলে প্রকৃত মালিক সাময়িকভাবে হলেও তার জমি থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
আইনের ৭ ধারায় মূলত সমস্যা
আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো জমি হালনাগাদ রেকর্ডে (খতিয়ান) আপনার নামে না থাকে, তাহলে সেই জমি আপনি দখলে রাখতে পারবেন না। তবে উত্তরাধিকারসূত্রে বা হস্তান্তরের মাধ্যমে মালিকানা প্রাপ্ত ব্যক্তি যদি রেকর্ড সংশোধন বা স্বত্ব ঘোষণার জন্য মামলা করেন, তবে তাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে না।
এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো প্রমাণ ও বিচারিক প্রক্রিয়া—কোন প্রমাণকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হবে, এবং মোবাইল কোর্টে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নিকট এই বিষয় পরিচালিত হলে কী ধরনের প্রশাসনিক প্রভাব তৈরি হবে।
এ আইনে মোবাইল কোর্ট থেকেই জমি নিয়ে নিবে প্রভাবশালিরা
আইন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত রায় প্রদানের কথা বলেছে, যেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও বিচার করতে পারবেন। দ্রুততা একদিকে ভালো, কিন্তু অন্য দিকে অপপ্রয়োগের আশঙ্কাও আছে—বিশেষত প্রভাবশালী বা কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা। ফলে প্রকৃত মালিকদের জমি থেকে উচ্ছেদ বা অনৈতিকভাবে দখলদারি বাড়তে পারে।
আইনের ৮(৭) ধারা বলে দেয় যে, যদি ভূমি-দখল সংক্রান্ত কোনো মামলা দেওয়ানি আদালতে বিচারাধীন থাকে, তাহলে একই বিষয়ে এই আইনের অধীনে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এ ধারা ইতিবাচক, তবে বাস্তবে প্রশাসন ও আদালতের মধ্যে সমন্বয় কতটা কার্যকর হবে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
এ আইনের ইতিবাচক দিক
- ভূমি জালিয়াতি ও প্রতারণা রোধে শক্তিশালী উদ্যোগ।
- সরকারি ও জনস্বার্থে ব্যবহৃত ভূমির সুরক্ষা।
- কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিকার প্রদান সম্ভব।
এ আইনের সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি
- খতিয়ানসহ দলিলের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা।
- মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে প্রশাসনিক অপব্যবহারের সম্ভাবনা।
- খতিয়ান সংশোধন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা প্রকৃত মালিককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী উদ্যোগ। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে কিভাবে আইনটি বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। রেকর্ড সংশোধন প্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত “দলিল যার, জমি তার”—এই স্লোগান বাস্তবে সবসময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে না।
লেখক: ইসরাঈল খান
হোয়টসএপ নাম্বারঃ- 01811-811182